প্রশ্নের উত্তর: ভূমিকম্প কাকে বলে? ভূমিকম্পের কেন্দ্র ও উপকেন্দ্র বলতে কী বোঝায়? ভূমিকম্প বলতে কি বুঝায়? ভূমিকম্পের প্রধান কারণ গুলি কি কি? এবং ভূমিকম্পের প্রভাব বা ফলাফল।
আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পর ভূমিকম্প সম্বন্ধিত সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখানে দেওয়া হয়েছে।
Table of Contents
ভূমিকম্প কাকে বলে?
ভূমিকম্প: ভূপৃষ্ঠের কিছু অংশ প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণের ফলে আকস্মিক ভাবে ক্ষনিকের জন্য কখনো মৃদু আবার কখনো প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠলে তাকে ভূমিকম্প বলে। এই কম্পনটির স্থায়িত্বের সময় হল কয়েক সেকেন্ড থেকে এক-দুই মিনিট।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র ও উপকেন্দ্র বলতে কী বোঝায়?
ভূমিকম্পের কেন্দ্র: ভূ-অভ্যন্তরে যে স্থানে কম্পনের তরঙ্গের উৎপত্তি লাভ করে, সেই স্থানটিকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা ফোকাশ বলে।
ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র: ভূ-অভ্যন্তরে অবস্থিত ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে সোজা উপরের দিকে ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত বিন্দু কে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বলে।
ভূমিকম্প বলতে কি বুঝায়?
ভূমিকম্প বলতে বোঝায়- ভূ-অভ্যন্তরে তরঙ্গ শক্তির উৎপন্নের ফলে, পৃথিবীপৃষ্ঠের কোন স্থানে যে আকস্মিক কম্পনের অনুভূত পাওয়া যায়। এই ভূকম্পন সৃষ্টি কারণ প্রাকৃতিক কিংবা মানবিক দুই হতে পারে এবং কিছু সেকেন্ড বা মিনিট এর জন্য হতে পারে।
ভূমিকম্পের প্রধান কারণ গুলি কি কি?
ভূমিকম্পের প্রধান কারণ গুলি হল ভূত্বক গঠন কারী পাতের সঞ্চালন, পৃথিবীর সংকোচন, আগ্নেয়গিরির অগ্নুপাত, নবীন ভঙ্গিল পর্বতের উত্থান, ভূতাপ শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টি, ভূগর্ভস্থ বাস্প, সমস্থিতি সমতা ইত্যাদি। ভূমিকম্পের কারণগুলি নিচে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা কারো করা হলো।
ভূমিকম্পের কারণ
ভূমিকম্পের কারণকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা (অ) প্রাকৃতিক কারণ এবং (আ) অপ্রাকৃতিক কারণ বা মানুষ সৃষ্ট কারণ।
(অ) ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ
আবার ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণগুলি কেউ দুটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) ভূগাঠনিক কারণ এবং (খ) অ-ভূগঠনিক কারণ।
(ক) ভূমিকম্পের ভূগাঠনিক কারণ
যে ভূমিকম্প ভূ-অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়ে থাকে তাকে ভূগাঠনিক ভূমিকম্প বলে। ভূপৃষ্ঠের ৯৫ শতাংশ ভূমিকম্প এই ভূ-গাঠনিক কারণ দ্বারা সৃষ্ট হয়। ভূগাঠনিক কারণগুলির উদাহরণ হল:
- অভিসারী পাত সীমান্তে অপেক্ষাকৃত ভারী ঘনত্বের পাত হালকা ঘনত্বের পাতের নিচে প্রবেশ করলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
- প্রতিসারী পাত সীমান্তে দুটি পাত একে অপরের থেকে দূরে সরে গেলে উভয় পাতের মধ্যবর্তী সীমান্তে চাপের তারতম্য় ঘটে, এই চাপের প্রভাবে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
- নিরপেক্ষ পাত সীমান্তে দুটি পাত পাশাপাশি একে অপরকে অতিক্রম করে তখনও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
- ভূগর্ভস্থ বাষ্প চাপ
ভূগর্ভের মধ্যে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে তা ভূগর্ভস্থ থেকে বেরিয়ে আসতে শিলাস্তরে প্রবল চাপের সৃষ্টি করে যার ফলে ভূমিকম্প হয়।
- পৃথিবীর সংকোচন
পৃথিবীর উৎপত্তির সময় থেকেই পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ বিকিরণ করে নিরন্তর শীতল ও সংকুচিত হয়ে চলেছে। এই দুই প্রক্রিয়ায় যথা বিকিরণ ও সংকোচনের মধ্যে সাদৃশ্য বজায় রাখতে পৃথিবীর শিলাস্তরের টান ও পিরনের সৃষ্টি হয়। এই টান ও পিরনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ভূমিকম্প ঘটে।
- অগ্নুৎপাত
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় জ্বালামুখ থেকে উত্তপ্ত তরল পদার্থ যথা লাভা ও বাষ্পরাশি প্রভৃতি নির্গত হয় এবং প্রচন্ড ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে।
- নবীন ভঙ্গিল পর্বতের উত্থান
নবীন ভঙ্গিল পর্বতে পর্বত গঠনের প্রক্রিয়া এখনো চলতে থাকায় এই অঞ্চল গুলিতে ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয়। যেমন- ১৯৫০ সালের আসামের গঠিত ভূমিকম্প।
(খ) ভূমিকম্পের অ-ভূগাঠনিক কারণ:
ভূমিকম্পে যে সকল প্রাকৃতিক কারণ গুলি ভূত্বকের বাহিরে সৃষ্টি হয় তাকে অ-ভূগাঠনিক কারণ বলা হয়। অ-ভূগাঠনিক কারণের উদাহরণ হল:
- ভূগর্ভস্থ গুহার ভাঙ্গন:
বৃহদাকৃতির গুহার ধ্বংসের ফলে তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
2. হিমানী সম্প্রপাত:
উঁচু পর্বত গোত্র থেকে বৃহদাকৃতির বরফের খন্ড মূল হিমবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে পাতিত হয়। যার ফলে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
3. উল্কাপাত:
মহাকাশ থেকে বিশালাকৃতির উল্কাপিন্ড ভূপৃষ্ঠের সম্পর্ষে এলেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে।
(আ) ভূমিকম্পের অপ্রাকৃতিক কারণ বা মানুষ সৃষ্ট কারণ
যে সকল ভূমিকম্পের কারণগুলি মানুষের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সৃষ্টি হয় তাই ভূমিকম্পের অপ্রাকৃতিক কারণ। ভূমিকম্পের অপ্রাকৃতিক কারণের উদাহরণ হল:
- পারমানবিক বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক্ষেত্রে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। যার ফলে বিস্ফোরণ গঠিত স্থানের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিস্ফোরণের তীব্রতার দ্বারা ভূমিকম্পের অনুভূত হয়।
- খনিগর্ভের ভাঙ্গন
ভূগর্ভ থেকে খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য ভূ-অভ্যন্তরে বিশাল সুরঙ্গের নির্মাণ করা হয়। এই সুরঙ্গ ধ্বংস হলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
- পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তাঘাট নির্মাণ:
পার্বত্য অঞ্চলে গুলিতে পাহাড় কেটে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সড়ক পথ নির্মাণ করা হয়। যার দ্বারা শিলাস্তরে ফাটল দেখা যায় ও ধ্বংসের সৃষ্টি হয় এবং ভূমিকম্পের কারণ হয়ে ওঠে।
এই ছিল ভূমিকম্পের সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক কারণসমূহ এবং মানুষ দ্বারা ঘটিত বা অ-প্রাকৃতিক কারণসমূহ।
ভূমিকম্পের প্রভাব বা ফলাফল:
ভূমিকম্পের তীব্রতা সামান্য হলে তা বেশিরভাগ সময় অনুভূত হয় না। অপরদিকে ভূমিকম্পের তীব্রতা অধিক হলে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণ সংকট দেখা দেয়।
তবে ভূমিকম্পের ফলে যেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার পাশাপাশি কিছু গঠনমূলক প্রভাবো লক্ষণীয়। তাই ভূমিকম্পের ফলাফল কে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়, যথা (ক) ধ্বংসাত্মক প্রভাব এবং (খ) গঠন মূলক প্রভাব।
(ক) ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক প্রভাব
ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের ফলে ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন ও মানব সভ্যতার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়। ভূমিকম্পের একাধিক ধ্বংসাত্মক প্রভাবের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ফলাফল হলো-
- ধসনামা
- চ্যুতির সৃষ্টি
- সমুদ্রতলের পরিবর্তন
- নদীর গতিপথে পরিবর্তন
- সমুদ্রতলের উত্থান অবনমন
- নদীর গতিপথে হ্রদ সৃষ্টি
- ভূগর্ভ থেকে জল ও বালি নির্গমন
- সমুদ্র উপকূলে ভূমিরূপ এর পরিবর্তন
- সুনামি সৃষ্টি
- জীবন ও সম্পত্তির ধ্বংস
- ধস নামা
ভূমিকম্পের দরুন পাহাড়-পর্বত অঞ্চলে বহু বার ধস নামতে দেখা যায় যার ফলে ওই অঞ্চলে ঘরবাড়ি গুলির বিনাশ ঘটে, প্রাণহানিও হয়।
- চ্যুতির সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে চুক্তির সৃষ্টি হয়। বহু সময় শিলাস্তর নিচে নেমে যায় এবং ওপরে উঠে যায়। ভূত্বকে ফাটলের সৃষ্টি হয়।
- নদীর গতিপথ পরিবর্তন
পার্বত্য অঞ্চলে নদীর পথে ধস নামলে নদীর গতি পরিবর্তিত হয়। ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ১৯৫০ সালে আসামে গঠিত ভূমিকম্পের প্রভাবে ডিবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন।
- ভূমির উত্থান ও অবনমন
ভূমিকম্পের ফলে উচ্চভূমি সমুদ্রে নিচে চলে যেতে পারে আবার সমুদ্র তলদেশের কিছু স্থান ওপরে উঠে যেতে পারে। ফলে দ্বীপ সৃষ্টি হয়।
- সুনামি সৃষ্টি
সমুদ্রের পাদদেশে ভূমিকম্প সৃষ্টি হলে সাগরে সুনামির সৃষ্টি হয়। বিশাল আকৃতির সমুদ্র ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ে উপকূল বসতি ধ্বংস হয় এবং উদ্ভিদের নাশ ঘটে।
- মানবীয় ক্ষয়ক্ষতি
উচ্চ তীব্রতা সম্পন্ন ভূমিকম্প কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শহর, নগর, জনপদ ধ্বংস করে দেয়। বহু ঘর-বাড়ি, বিল্ডিং, সেতু নিমিষের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে যায়। ভূমিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়, বিদ্যুৎ লাইনে শট সার্কিট লাগে, আগুন ধরে যায়।
(খ) ভূমিকম্পের গঠনমূলক প্রভাব
প্রতিটি ধ্বংসাত্মক জিনিসের গঠনমূলক কিছু ভূমিকা থাকে। তেমনি ভূমিকম্পের উল্লেখযোগ্য কিছু গঠনমূলক প্রভাবের উদাহরণ হল-
- ভূ অভ্যন্তরীণ তথ্য প্রদান
ভূ- অভ্যন্তরের গঠনমূলক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে একমাত্র উপায় হল ভূমিকম্প তরঙ্গ। ভূমিকম্পের P,S,L তরঙ্গ দ্বারা পৃথিবীর অভ্যন্তরের চাপ, তাপ, বিযুক্তি রেখা প্রভৃতি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।
- মৃত্তিকা গঠন
ভূমিকম্পের ফলে বহু শিলা পাহাড়-পর্বত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে পাতিত হয়। এই শিলা গুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে আবহবিকার প্রক্রিয়া চলার তরুণ মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
- খনিজ সম্পদের প্রাপ্তি
ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে ফাটলের উৎপত্তি ঘটে। এই ফাটল গুলি থেকে অগ্নুৎপাতের লাভা বেরিয়ে এসে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। বহু ধরনের খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়।
- হ্রদের সৃষ্টি
ভূমিকম্পের ফলে অবনমিত ভূমি সৃষ্টি হয়। এই স্থানে জল জমাট বাধার ফলে হ্রদের সৃষ্টি হয়।
অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর:
ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের নাম কি?
ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের নাম সিসমোগ্রাফ।
“ভূমিকম্প কাকে বলে? ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল” ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই উত্তরটি তোমারদের ভালো লেগে থাকলে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সাথেও পোস্টটি শেয়ার করবে।
আমি Sharmila, MoneyGita একজন Author। বর্তমানে আমি গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করছি এবং লেখালেখি আমার ভালোবাসার একটি কাজ। এই প্লাটফর্মে আমি নিয়মিত আমার লেখালেখির কাজ করে থাকি। সরকারি স্কুলের ছাত্রদের পড়ায়, সিলেবাস অনুযায়ি পরীক্ষার প্রশ্ন-উত্তর করিয়ে থাকি।