একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনাটি অভিজ্ঞ শিক্ষিকার দ্বারা রচিত। যা খুবই সুন্দরভাবে গুছিয়ে এবং পয়েন্ট ভিত্তিক করে লেখা হয়েছে ।সাথে এ রচনাটির PDF সংগ্রহ লিংক নিচে দেওয়া হয়েছে। আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
Table of Contents
একটি নদীর আত্মকথা
আমরা ভারতবাসী, আমরা প্রতিটি বস্তু জিব গাছ নদী ইত্যাদির মধ্যে ভগবানকে খুঁজে পাই ও পূজো করি এবং সম্মান করি। ভারত নদীমাতৃক দেশ আমরা নদীকে মায়ের স্বরূপ পূজা করি। এখানে গঙ্গা, তিস্তা, গোদাবরী, যমুনা, কাবেরী ইত্যাদি নানান নদী আছে।
আমরা ছোট থেকে গঙ্গা নদীর সঙ্গে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছি। আমাদের জীবনে গঙ্গা নদী অতি পরিচিত একটি নদী। এই অতি পরিচিত নদীটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ধার্মিক কাজকর্মে যেন বন্ধু হিসেবে প্রয়োজন পড়ে।
নিজে আজ এই বন্ধুটি হয়ে একটি রচনা তুলে ধরলাম,নাম দিলাম একটি নদীর আত্মকথা। আত্মকথা লেখা বেশ কঠিন কাজ তাই নিজের ও সকলের স্বার্থে গঙ্গা নদীর আত্মকথা সহজবোধ্য ভাবে উপস্থাপিত করলাম।
ভূমিকা
আমার নাম গঙ্গা। আমি বিশ্বে একটি অতি পরিচিত নদী। এই পরিচিতি পেয়েছি পুরান ও মানুষের ভক্তি থেকে। আমি কখনো চঞ্চল কখনো শান্ত শীতল। আমার বিভিন্ন রূপ সকলকে মুগ্ধ ও আকর্ষণ করে। আমার সৃষ্টি ভারতবর্ষে।
ভারতকে আমার জন্মস্থান বলা যায়। পবিত্র নদী হিসেবে আমার খ্যাতি রয়েছে। আমায় নিয়ে গান, কবিতা, গল্প লেখা হয়েছে। ওই যে- “ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন…..”। আমি দেবী রূপে পূজিত হয়। আমার আত্মকথা মানে গঙ্গা নদীর আত্মকথা সবার মনে কৌতুহল সৃষ্টি করবে।
আমার আত্মকথা মানেই গঙ্গা নদীর আত্মকথা সবার মনে কৌতুহল সৃষ্টি করবে, প্রশ্ন জাগাবে.
আমার উৎপত্তি
আমার উৎপত্তি নিয়ে পৌরাণিক কাহিনী আছে, আছে ভিন্ন মতও। পুরান অনুসারে, আমাকে ভাগীরথী নামক এক মুনি মর্তে মানে পৃথিবীতে আনার জন্য তপস্যা করেছিলেন। সেই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবতা আমায় মর্তে পাঠান।
কিন্তু আমি এতটাই চঞ্চল ছিলাম যে সমস্ত কিছু ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, এইমত অবস্থায় আমার জলোচ্ছ্বাস বা চঞ্চলতা কমানোর জন্য মহাদেব নিজে জটায় ধারণ করে মর্তে অবতরণ করলেন। তাতে আমার স্রোত শীতল হলো যা মানবজাতির জন্য উপকারী হল।
হিন্দু সংস্কৃতিতে ভাগীরথীর উৎস স্থলকেয় আমার উৎস স্থল বলে মানে। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ কেই আমার উৎস স্থল বলে। তবে ভাগীরথী ও অলক নন্দার সঙ্গমস্থল থেকে মূল গঙ্গা শুরু। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়ওয়াল অঞ্চলটি আমার উৎস অঞ্চল। আমি বরফ গলা জলে পুষ্ট নদী।
সর্বোপরি আমার উৎপত্তি নিয়ে কাহিনী ও মর্তের শেষ নেই। আমাকে নিয়ে জনসাধারণের ভেতরে যে উচ্ছ্বাস তা আর অন্য কোন নদীর নেই। উত্তর ও মধ্য ভারতের আমিই প্রধান নদী।
আমার প্রবাহ ও গতিপথ
আমি একটি আদর্শ নদী সকলের কাছে আমি আদর্শ নদীর বড় উদাহরণও বটে। আমার প্রবাহ পথে তিনটি প্রবাহ বর্তমান। সেগুলি হল উচ্চ প্রবাহ, মধ্য প্রবাহ এবং নিম্ন প্রবাহ। উচ্চ প্রবাহে আমি উচ্ছল গতিময় সুন্দরী এক মেয়ে, আমার স্রোতের আঘাতে শত শত পাথর খান খান হয়।
খরস্রোতে আমি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলি নিজের পথে। চলতে চলতে দুই পাশে তাদের জমা করতে করতে আমার গতি মধ্যমা। তখন আমার জলপ্রবাহ মধ্যপ্রবাহ। পলি পাথর জমা করতে করতে আমি শান্ত হয়ে পড়ি এখানে আমার নিম্ন প্রবাহ।
আমার গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা 40 কোটি এবং জনঘনত্ব ৩৯০/বর্গ কিমি। আমি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা। উত্তর ভারত এবং আর্যাবর্ত কে অতিক্রম করে ২৫০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গৌরবঙ্গে প্রবেশ করে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে সাগরের সাথে মিলিত হয়েছি। ভারতে আমিই এতোখানি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা নদী।
আমার পৌরাণিক কাহিনী
স্বর্গ থেকে মর্তে অবতরণ নিয়ে রয়েছে প্রাচীন ও পৌরাণিক কাহিনী। তার মধ্যে মহাদেবের জটায় আমায় ধারণ, ব্রহ্মার কুমন্ডল, রাজা শান্তনু ও অষ্টবসুর কাহিনী, ভীষ্ম আমার সন্তান বলে মহাভারতে বিখ্যাত ও প্রচারিত।
আমার উদ্দাম জলপ্রবাহে জহ্নু মুনির আশ্রম ভেসে যায়। এই অপরাধে জহ্নু মনি আমায় পান করে ফেলেন। তারপর জানু চিরে তিনি আমায় বের করে মুক্তি দেন। তখন থেকে আমি এক নাম পায় জাহ্নবী।
আমাতে সমৃদ্ধ নগরী
আমার তীরে বহু সমৃদ্ধ নগরী গড়ে উঠেছে উল্লেখ্য হরিদ্বার, বারানসী, এলাহাবাদ, কলকাতা প্রভৃতি। বারানসীর গঙ্গা আরতি জনসাধারণকে টানে। এখানে আমার আরতী দেখতে দেশ-দেশান্তর থেকে মানুষের ভিড় জমে।
ওইসব নগরীতে সামরিক দুর্গও গড়ে উঠেছে। যেমন কলকাতার ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ হল এই ধরনের দুর্গ। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ আমার কূলেই পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা গুলি গড়ে উঠেছে আমাকে কেন্দ্র করেই।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান
আমার জল সিঞ্চনে পবিত্র হয়। আমার জলে পিতৃপুরুষের তর্পণ করে। আমার জলে দেবতাদের আহ্বান করা হয়। আমার সাগরের সাথে মিলিত স্থান মোহনাতে আমাকে কেন্দ্র করে গঙ্গাসাগর মেলা বসে বছরের নির্দিষ্ট পুণ্য তিথিতে।
বিভিন্ন পূর্ণ তিথিতে আমার বক্ষে স্নানে সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলে মানুষ জন। আমি সবার পাপ হরণ করে পবিত্র করি। সকাল সন্ধ্যা আমাকে স্মরণ করে পূজা আরতি করা হয়। আমি পবিত্র সলিলা।
নদী তীরবর্তী অঞ্চল
আমার তীরে তীরে গড়ে উঠেছে অনেক স্নানের ঘাট। রয়েছে অরণ্য তীর্থস্থান, শহর ইত্যাদি। ঋষিকেশ, হরিদ্বার, বারানসী, প্রয়াগ তীর্থ স্থান গুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হরিদ্বারের হর-কি-পৌরি খুবই বিখ্যাত। বারানসীর তীরে অসংখ্য ঘাট আছে।
প্রয়াগ তীর্থে আমার প্রশস্তি পাঠ হয়। এখানে যমুনা নদীর সঙ্গে আমি মিলিত হয়েছি। আমার গতিপথের তীরে তীরে রয়েছে অনেক শ্মশান। এই শ্মশান গুলিতে মৃতদেহ দাহ করে। কথিত আছে গঙ্গার তীরে মৃতদেহ দাহ করে ভস্ম গঙ্গা জলে দিলে মৃতের আত্মার সদগতি হয়।
বারাণসীর কাশি ধামের মণিকর্ণিকা শ্মশানে স্বয়ং মহাদেব মৃতের কানে মন্ত্র পাঠ করে দেন এমনই প্রচলিত আছে লোকমুখে। আমার তীরে তীরে প্রচুর চাষাবাদও হয়। আমার তীরের জমিগুলি খুবই উর্বর প্রকৃতির।
এইসব জমি আমার জলে পুষ্ট। প্রচুর ফসল ও ফলে প্রচুর ধান, গম, পাট, আঁখও হয়। আমার উপর অনেক সেতু বন্দর গড়ে উঠেছে। কলকাতার হাওড়া ব্রিজ, ফারাক্কা ব্রিজ উল্লেখ্য। কলকারখানাও গড়ে উঠেছে আমাকে কেন্দ্র করে।
জীবিকা নির্বাহ
আমার বক্ষে রয়েছে প্রচুর মাছ। এই মাছ জেলেদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান কারণ। আমাকে কেন্দ্র করে জাহাজ লঞ্চের মাধ্যমে আমদানি রপ্তানিও করা হয়। আমার তীরের বালি-কাদা মানুষের কাজে লাগে। কাদা দিয়ে প্রতিমা গড়া হয়।
আমার আর সাগরের মিলিত স্থান মোহনাতে বাঙ্গালীদের অতি প্রিয় ইলিশ মাছের চাষ হয়। এই মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়।
খারাপ দিক
বর্ষাকালে চারিদিক থেকে জল এসে আমাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। তখন আমি দুর্বার গতি নিয়ে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর খেয়েছি, সমস্ত কিছু প্লাবিত করি। বন্যায় হাজার মানুষ ও জীবজন্তুর ক্ষতি করি।
গঙ্গা দূষণ
আমার দূষণ চর্চিত বিষয়। আমার জলে দূষিত পদার্থ মেশায় খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হচ্ছে। যা সকলের জন্য ক্ষতিকারক। কলকারখানার দূষিত পদার্থ আমার জলে মিশে জলে থাকা জীবেদের ক্ষতি করছে। অত্যধিক নোংরা জমে আমার গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আমাকে মা রূপে পূজা করেও আমায় দূষিত করছো তোমরা।
উপসংহার
আমি দেবলোকে অলক নন্দা ও মন্দাকিনী এবং পাতালে ভোগবতী। আমি পাপহারিনি। আমি তোমাদের পূণ্য লাভ করায়। আমার পক্ষে এত সব দূষণ নিয়েও আমি আনন্দিত যে, যে আমার সন্তান সমমানুষ মানে যারা এই দূষণের কর্মকর্তা তারাই আমার দূষণ রোধে অনেক প্রকল্প তৈরি করছে।
তাই আমার মা স্বরূপ সম্মানিত এবং গর্বিত। আমার গঙ্গা নামেই পবিত্রতা রয়েছে তাই এই দূষণ রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা এবং সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে।
রচনাটির লেখিকা– রিয়া দাস।
(একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা)
___________________________________
একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা [PDF]
একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনাটির PDF টি নিচে দেওয়া লিঙ্ক থেকে তোমরা সংগ্রহ করতে পারবে।
“একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ” রচনাটি তোমাদের ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এই আর্টিকেলটি শেয়ার করবে।
হাউস ওয়াইফ, অবসর সময়ে লেখালিখি (M.A in Bengali)