সবুজ বিপ্লব কাকে বলে?- কি, সংজ্ঞা, প্রভাব

প্রধান বিষয়: সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি? ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব গুলি যথা- (1) সুফল প্রভাব (2) কুফল প্রভাব। এই সকল প্রশ্নের সঠিক ও বিস্তারিত উত্তর পয়েন্ট অনুযায়ী নিচে দেওয়া হয়েছে।

এ সকল প্রশ্নের সাথে সাথে অতিরিক্ত সবুজ বিপ্লবের উপকরণ গুলি দুটি ভাগে ভাগ করে-(i) প্রধান উপকরণ (ii) অন্যান্য উপকরণ গুলি দেওয়া হয়েছে। নিচে সংজ্ঞা দেওয়া হলো- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি?

Table of Contents

সবুজ বিপ্লব কি 

সবুজ বিপ্লব কি
সবুজ বিপ্লব কি

সবুজ বিপ্লব কি বলতে বোঝায়: সবুজ অর্থাৎ কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। আমরা জানি, প্রাচীনকালে প্রথাগত পদ্ধতিতে মানুষ চাষবাস করত। এই প্রথাগত পদ্ধতিতে তাদের কৃষি কাজের জন্য ফসল ঠিকমতো উৎপন্ন হতো না, অনেক সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। মানুষ অনাহারে দিন যাপন করতো। খাদ্য উৎপাদনের পরিকাঠামো ছিল খুবই দুর্বল। 

জলচক্র কাকে বলে

এই কারণে প্রায়শই কৃষি কাজ ব্যাহত হতো। খাদ্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেত। এর ফলে সমাজের পরিকাঠামো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ আবিষ্কার করল উন্নত মানের ফসলের বীজ, কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি, সার এবং উন্নত কৃষি কাজের পদ্ধতি।

এর ফলে কৃষি ক্ষেত্রে দেখা দিল আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন হলো সবুজ বিপ্লব। ফসলের রং সবুজ হওয়ায় এই আমূল পরিবর্তনের নামকরণ করা হয়েছে সবুজ বিপ্লব। 

সবুজ বিপ্লব কি জানার পর আসুন সবুজ বিপ্লবের মূল বিষয় গুলিকে জানা যাক বিস্তারিতভাবে- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে ?

সবুজ বিপ্লব কাকে বলে

সুবীর বিপ্লব হলো: ১৯৬০ এর দশকে ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে উন্নত পদ্ধতি (যেমন- রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জলসেচের প্রসার, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার, কীটনাশকের প্রয়োগ প্রভৃতি) ব্যবহার করার ফলে, ফসলের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের এই বিপুল পরিবর্তনকেই সবুজ বিপ্লব বলে।

যেহেতু উৎপাদিত ফসলের রং সবুজ তাই এই পরিবর্তনকে সবুজ বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সবুজ বিপ্লব এর ফলে সমগ্র কৃষিজমি  সবুজে ভরে ওঠে, দিগন্ত পর্যন্ত যেন এই সবুজের সমারোহ।

স্বাধীনতার পূর্বে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও মানুষ প্রথাগত পদ্ধতিতেই তাদের কৃষিকাজ করত। প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণের ফলে অনেক সময় ফসল নষ্ট হয়ে যেত। আবার কখনো কখনো ফসল উৎপাদন ঠিক মতো হতো না। ফলন কম হতো। এর ফলে প্রায়শই দুর্ভিক্ষ এবং অনাহারে মানুষ জীবন যাপন করত। 

এরপর কৃষি ক্ষেত্রে কৃষি পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য এবং খাদ্য সমস্যা মেটানোর জন্য ১৯৬০ এর দশকে ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক ও উন্নত মানের উপকরণের প্রয়োগ শুরু করা হয়। মূলত উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার, জলসেচের প্রসার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পর্যাপ্ত প্রয়োগ, ‘প্যাকেজ ডিল’ পদ্ধতিতে কৃষিকাজ শুরু হয়। 

এর ফলস্বরূপ উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের পশ্চিমভাগে ফসলের উৎপাদন বিপুল পরিমানে বৃদ্ধি পায়। কৃষি ক্ষেত্রে এই আমূল পরিবর্তনকেই সবুজ বিপ্লব বলা হয়। 

ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব

ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব কে মূলত দুতি ভাবে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (1) সবুজ বিপ্লবের সুফল (2) সবুজ বিপ্লবের সুফল। নিচে সবুজ বিপ্লবের সুফল এবং কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

সবুজ বিপ্লবের সুফল:

সবুজ বিপ্লবের সুফল হিসেবে দেখা গিয়েছে সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। যেমন-

1. মোট উৎপাদন বৃদ্ধি:

তৃতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী দেখা যায়- সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৮.২ কোটি টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 2011-12 সালে তা ২৫.৭৪ কোটি টনে এসে দাঁড়ায়। এর ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। 

2. হেক্টর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি :

সবুজ বিপ্লবের প্রধান উপকরণগুলি (উচ্চফলনশীল বীজ, জল সেচের সুবিধা এবং কৃষি ক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার) ব্যবহারের ফলে জমির হেক্টর প্রতি ফসল উৎপাদন বেরে যায়।

উচ্চ ফলনশীল বীজ, জলসেচ, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার এবং পাশাপাশি উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ফলে হেক্টর প্রতি খাদ্যশস্যের উৎপাদন ২০০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৯৮ কেজিতে।

3. খাদ্য সমস্যার সমাধান:

প্রথাগত বা পুরনো পদ্ধতিতে চাষবাসের ফলে ভারতের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে প্রচুর খাদ্যাভাব দেখা যায়। কারণ দেশভাগের পর, ভারতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। 

কৃষি কাজের উন্নতি না থাকায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল উৎপন্ন না হওয়ায় খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব হয়।

4. কৃষকের আর্থিক উন্নতি :

সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষি জমি থেকে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কৃষকদের আয় বাড়তে থাকে এবং তাদের জীবনযাত্রার আর্থিক উন্নতি ঘটে। 

5. শিল্পের বিকাশ:

সবুজ বিপ্লবের ফলে বেশ কিছু শিল্পের বিপুল বিকাশ ঘটে। যেমন- কার্পাস-বয়ন শিল্প, শর্করা শিল্প, বনস্পতি শিল্প ইত্যাদি।

6. গ্রামীণ কর্মসংস্থান:

সবুজ বিপ্লবের ফলে বহু গ্রামের লোকেরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এর ফলে বহু গরিব গ্রামীণ লোকেরা কাজের সন্ধান পায়। এছাড়াও কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণ কারখানা গুলিতে বহু লোক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

সবুজ বিপ্লবের কুফল:

সবুজ বিপ্লবের বেশ কিছু কুফল বা ক্ষতিকারক প্রভাবও রয়েছে। নিচে সবুজ বিপ্লবের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। 

1. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি:

সবুজ বিপ্লবের সাফল্য সকল অঞ্চলে সমানভাবে বিস্তার লাভ করতে পারিনি। ভারতে যে অঞ্চল গুলি সর্বাধিক সাফল্য লাভ করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা। ভারতের কেরল, বিহার, অসম প্রভৃতি অঞ্চলে সবুজ বিপ্লবের তেমন কোন প্রভাব দেখা দেয়নি। যার ফলে সবুজ বিপ্লবে আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দেয়।

2. আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি:

শুধুমাত্র আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি নয়, আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধিও ঘটেছিল। সবুজ বিপ্লবের সফলতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কৃষক দের আর্থিক অগ্রগতি লাভ পেয়েছিল।

অপরদিকে বেশ কিছু দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা সবুজ বিপ্লবের উন্নত পদ্ধতি যেমন- উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার, আধুনিক যন্ত্রপাতি সহ রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করতে পারায় তাদের খাদ্য শস্য উৎপাদন হ্রাস পায়। 

যার ফলে কৃষকদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। একদিকে ধনী কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায় এবং অপরদিকে দরিদ্র তথা প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষীদের আর্থিক আয় তুলনামূলক কম হয়।

3. কর্মসংস্থান হ্রাস: 

সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষি জমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োগের ফলে কৃষি ব্যবস্থা সহজ হলেও অপরদিকে কর্মসংস্থান এর হ্রাস দেখা দেয় 

4. শস্য উৎপাদনে অসমানতা:

সবুজ বিপ্লবে খাদ্য শস্যের মধ্যে প্রধানত গমের উৎপাদন সর্বাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যান্য শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তারা খুবই অমনোযোগী হয়ে পড়ে। গম উৎপাদনকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। সবুজ বিপ্লব কে অনেকেই গম বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন।

5. কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের অসুবিধা:

 কৃষিকাজে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি গুলির দ্বারা মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

6. রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার:

 বর্তমানে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় হতে দেখা যায়। এই রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত প্রয়োগের ফলে মৃত্তিকা ও জল দূষিত হয়। মাটির ভালো গুনাগুন নষ্ট হয়। 

জলজ জীবের মৃত্যু ঘটে। এবং এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের ও যথেষ্ট অবনতি ঘটছে। আবার শস্যের উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। 

7. জল দূষণ

সবুজ বিপ্লবের ফলে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কৃষি জমিতে প্রচুর মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক গুলির ব্যবহার বাড়তে থাকে।  মিতে ব্যবহার করা এই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক গুলি বৃষ্টির জলের সাথে বয়ে আশেপাশের জলাশয় গুলিকে দূষিত করে।

শুধুমাত্র জলাশয় নয় সমুদ্রের প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে এর কু-প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

8. মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস 

এই সকল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক গুলির অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করার ফলে কৃষি জমির ফসল উৎপাদন করার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে অর্থাৎ মৃত্তিকা উর্বরতা হ্রাস পায়। সাথে সাথে জল সেচের ফলে মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

সবুজ বিপ্লবের এই সকল কুপ্রভাব গুলির ফলে অনেকেই সবুজ বিপ্লবের কে ‘ধূসর বিপ্লব’  বলে থাকেন। প্রত্যেকটি জিনিসেরই সুফল এবং কুফল দিক রয়েছে। অর্থাৎ কোন জিনিস শুধুমাত্র সুফল দিতে পারেনা। আবার কোন জিনিস শুধুমাত্র কুফল দিতে পারেনা। তাই প্রত্যেকটা জিনিসের ক্ষেত্রে নিজস্ব সুফল এবং কুফল রয়েছে। তেমনই সবুজ বিপ্লবের ফলে সুফল যেমন হয়েছে। তেমনি কিছু কুপ্রভাবও দেখা গিয়েছে। 

এই পোস্টের মূল প্রশ্ন- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি?

সবুজ বিপ্লবের উপকরণ:

শুধুমাত্র উচ্চ ফলনশীল গম বীজ নয়, পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রেও নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়। এগুলিকেই ‘সবুজ বিপ্লবের স্তম্ভ’ বা ‘সবুজ বিপ্লবের উপকরণ’ বলা হয়। সাধারণত সবুজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে ১২ টি উপকরণ নির্বাচন করা হয়েছে। এই উপকরণ গুলির মধ্যে প্রধান উপকরণ হলো 4 টি। 

নিচে ‘সবুজ বিপ্লবের উপকরণ’ গুলি আলোচনা করা হলো:

সবুজ বিপ্লবের উপকরণ:প্রধান উপকরণঅন্যান্য উপকরণ
1.উচ্চ ফলনশীল বীজপাট্টা তহবিল
2.রাসায়নিক সারভূমি সংস্কার
3.জলসেচমূলধন বা ঋণ
4.কীটনাশক ওষুধগ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ
5.গ্রামীণ রাস্তা ও বাজার সৃষ্টি
6.কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন
7.খামারের যান্ত্রিকীকরণ 
8.সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন

1. উচ্চ ফলনশীল বীজ:

ভারতের সবুজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি হল কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার। প্রাচীনকালে, যে পুরনো বীজ কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতো, তার তুলনায় এই উচ্চ ফলনশীল বীজের উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই বেশি। সবুজ বিপ্লবের সূচনা ঘটে উচ্চ ফলনশীল গম বীজের হাত ধরেই।

শুধুমাত্র গম বীজই নয় , উচ্চ ফলনশীল ধান, জোয়ার ,বাজরা, ভুট্টাও এই উচ্চ ফলনশীল বীজ এর অন্তর্গত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কৃষিজমি ছিল প্রায় ৪০ হেক্টর কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ ফলনশীল বীজের আওতায় কৃষি জমি বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৫ লক্ষ হেক্টর। অর্থাৎ এই উচ্চ ফলনশীল বীজ সবুজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রধান চাবিকাঠি।

2. জলসেচ:

সবুজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উপকরণ টি হল জল সেচ। কৃষি -কাজের জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়। এই কারণে উচ্চ ফলনশীল বীজের পাশাপাশি উন্নত জলসেচ ব্যবস্থারও প্রয়োজন।তাই শুধুমাত্র বৃষ্টির জল এবং ভূপৃষ্ঠস্থ জলই নয়, ইহার পাশাপাশি ভৌম জলেরও ব্যাপক পরিমাণ ব্যবহার শুরু হয় জল সেচের জন্য।

 তবে প্রচুর পরিমাণে ও অবাধ ভাবে ভৌম জল ব্যবহারের ফলে ভৌম জলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ ভৌম জলতল ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। জলের অভাবে এই জল সেচের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা সহ বহু জেলা।

3. রাসায়নিক সার:

জমির পুষ্টি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগুলির পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এর ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাই ফসলের  উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য  রাসায়নিক সারের প্রয়োগ করা হয় কৃষি ক্ষেত্রে। 

উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রাসায়নিক সারের প্রয়োগও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৪-১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতি হেক্টর কৃষি-জমিতে ১৭ কেজি  করে রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ২০১২-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাসায়নিক সারের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২৮.৩৫ কেজিতে।

4. কীটনাশক:

উচ্চ ফলনশীল বীজ, জল সেচ, রাসায়নিক সার -এর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান একটি উপকরণ হলো কীটনাশক ওষুধ। উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত শস্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

দেখা গেছে, ভারতে উৎপাদিত শস্যে কিছু রোগের সৃষ্টি হয় যার ফলে শস্যের একাধিক অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রকম কীটপতঙ্গও এই শস্যের ক্ষতি করে। এর ফলে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ খুবই কম হয়ে পড়ে। প্রতিবছর ভারতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার শস্য বিনষ্ট হয়।

তাই এই সমস্ত রোগের প্রতিষেধক রূপে   কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে শুধুমাত্র শস্যের রোগ নিরাময়েই নয়,বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গের উপদ্রব থেকেও শস্যকে বাঁচানো সম্ভব হয়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে ফসল সংরক্ষিত হয় এবং এর  উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

এই পোস্টের মূল প্রশ্ন- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি?

5. সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন:

সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন হল সবুজ বিপ্লবের উপকরণ এর মধ্যে একটি। সক্রিয় এলাকা উন্নয়ন হল একটি প্রকল্প । এটি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে শুরু  করা হয়। এই প্রকল্পের দ্বারা মৃত্তিকা জরিপ, ভূমির আকৃতি নির্ণয়, জমির মধ্যে খাল খনন, জলের সঠিক নিষ্কাশন ইত্যাদির উন্নয়ন ঘটানো হয়।

 ইহার পাশাপাশি এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শস্য বিন্যাস,জল নিকাশি ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এবং জল সেচের আধুনিকীকরণ ঘটানো হয়।

6. পাট্টা তহবিল:

ভারতীয় কৃষকদের কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য পাট্টা তহবিল গঠন করা হয়। পাট্টা তহবিলের লক্ষ্য ছিল ভারতের ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন ভূমি কে কৃষকদের মধ্যে বিলি করা। পাট্টা তহবিল গঠনের ফলে ভারতে কৃষি উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়। এবং কৃষকরা শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

7. ভূমি সংস্কার:

কৃষি উন্নতির জন্য কৃষি জমিগুলির সংস্কার করার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। জমিদারী প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়, এছাড়াও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন- প্রজাস্বত্বের সংস্কার, অপারেশন বর্গা, জমির মালিকানা, সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ। এই সবের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব ঘটে। জমি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

8. মূলধন বা ঋণ:

 ফসল উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের প্রয়োজন। কারণ উচ্চ ফলনশীল বীজ রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ওষুধ কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ কৃষকদের কাছে পর্যাপ্ত মূলধন থাকেনা । এই কারণে কৃষি কাজের জন্য তাদের বিশেষ কৃষি ঋণ দেওয়া হয়। কিছু সহজ শর্তের বিনিময়ে কৃষকদের গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ দেওয়া হয়।

9. গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ :

প্রথাগত পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাষবাস করার ফলেই সবুজ বিপ্লব ঘটে। এই আধুনিক এবং উন্নত মানের যন্ত্রপাতি গুলি বেশিরভাগ টাই বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। যেমন জল সেচের ক্ষেত্রে বর্তমানে পাম্প ব্যবহৃত হয়। 

এই পাম্পের সাহায্যে  কৃষি জমিতে জল সেচ করা হয়। পাম্প চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন। বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলেই এই বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়েছে।

 যেমন- পাঞ্জাব, কেরালা ,অন্ধ্রপ্রদেশ ,কর্ণাটক, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ ,তামিলনাড়ু, জম্মু ও কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র এবং নাগাল্যান্ডের ৫৭ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ গ্রামে এই বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি ব্যবস্থায় বিপুল উন্নতি ঘটেছে।

10. গ্রামীণ রাস্তা ও বাজার সৃষ্টি

গ্রামীণ রাস্তা গুলি মেরামত করা হয়। এবং একাধিক পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাস্তাগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দ্বারা পরি- কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। এর পাশাপাশি  একাধিক গ্রামীণ বাজারের সৃষ্টি করা হয়েছে।

এই বাজারে উৎপাদিত ফসল ও শস্য বিক্রি করা হয়। গ্রামীণ রাস্তা ও বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব সার্থক হয় এবং খাদ্য সমস্যার অবলুপ্তি করণ ঘটে।

11. খামারের যান্ত্রিকীকরণ:

সবুজ বিপ্লবের অন্যতম একটি উপকরণ হল খামারে যান্ত্রিকীকরণ পুরনো প্রথাগত যন্ত্রপাতিগুলির ব্যবহার বন্ধ করে, তার পরিবর্তে উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ফলে সবুজ বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয় এবং বহু স্থানে বহু- ফসলি উৎপাদন শুরু হয়।

12. কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন:

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে কিছু নতুন কৌশল প্রবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে উন্নত ফলনশীল বীজ এবং ফসল সম্পর্কে পরীক্ষা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। 

ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে কৃষি উন্নতির জন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ।এই রাজ্যগুলি হল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কৃষি কাজের অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন “Agriculture Research Centre” গড়ে উঠে।

এই পোস্টের মূল প্রশ্ন- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি?

ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা (Green Revolution)

সবুজ বিপ্লবের সূচনা সর্বপ্রথম মেক্সিকোতে হয় ১৯৫১ সালে। এই মেক্সিকোতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন Dr. Norman Earnest  Borlaug। এই সবুজ বিপ্লবটি হয়েছিল গম বীজ উৎপাদনের দ্বারা।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের সূচনা: ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময় কাল গুলিতে ভারতের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ভারতের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্যের যোগান ছিল না, যার ফলে ১৯৬১ সালে ভারতকে দুর্ভিক্ষ সম্মুখীন হতে হয়।

এই সকল সমস্যার সমাধানের জন্য তৎকালীন ভারতের কিছু কৃষি বিশেষজ্ঞরা ১৯৬৩ সালে Dr. Norman Earnest  Borlaug কে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান।

Dr. Norman Earnest  Borlaug এবং ভারতীয় ড: এম এস এ স্বামীনাথন সহ প্রচেষ্টাই ভারতে প্রায় 100 কোটি উচ্চফলনশীল গমবীজের আমদানি করা হয়। এই উচ্চ ফলনশীল গম বীজ  গুলিকে জমিতে চাষ করে। ফসলের উৎপাদন প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ভারতে খাদ্যশস্য পরিমান বেরে যায়।

সবুজ বিপ্লবের অঞ্চল (Green Revolution)

সবুজ বিপ্লবের প্রথম দিকে এর ব্যাপক প্রভাব কেবল উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা দেয়। তারপর আস্তে আস্তে সবুজ বিপ্লবের অঞ্চল হিসেবে পূর্ব রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি অঞ্চলেও এর বিস্তার লাভ করে।

এই পোস্টের মূল প্রশ্ন- সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি?

অন্যান্য পোস্ট গুলি-

আশা করি বন্ধুরা আপনাদের এই সবুজ বিপ্লব কাকে বলে বা সবুজ বিপ্লব কি? (ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব) প্রশ্নের উত্তরটি কে আমরা আপনাদেরকে সঠিক ও যথার্থ তথ্য প্রদান করতে পেরেছি। আমাদের এই পোস্টটি ভালো লাগলে আমাদের অন্যান্য পোস্টগুলি দেখতে পারেন। ধন্যবাদ।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের প্রধান ফসলের নাম কি?

ভারতের সবুজ বিপ্লবের প্রধান ফসলের নাম হলো গম। পরবর্তীকালে অন্যান্য খাদ্যশস্য যেমন ধান ও দানা জাতীয় খাদ্যশস্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

সবুজ বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল?

সবুজ বিপ্লব সর্ব প্রথম মেক্সিকোতে হয়েছিল। এরপর ভারতে ১৯৬৪- ৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর সবুজ বিপ্লব হয়, এর বেশি প্রভাব দেখা যায় উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা অঞ্চলে।

সবুজ বিপ্লব কত সালে হয়?

সর্বপ্রথম সবুজ বিপ্লবের সূচনা 1951 সালে মেক্সিকোতে হয়। ভারতের সবুজ বিপ্লব সর্বপ্রথম ১৯৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল খরার বছরে।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের নায়ক কে?

ভারতের সবুজ বিপ্লবের নায়ক হলেন ড: এম এস এ স্বামীনাথন। 

Leave a Comment